Post by
Kalipada Roy
গৃহযুদ্ধ
কালীপদ রায়
শহরের রেল স্টেশন সংলগ্ল এমনই একটি চায়ের দোকান চালান সামন্ত বাবু৷ ইচ্ছা থাকা সত্বেও শিক্ষায় খুব একটা এগোতে পারেননি তিনি অর্থনৈতিক চরম কষাঘাতের কারণে৷
মোটামোটি দোকানটা চলে, তবে খুব যে চলে তেমন নয়, আড্ডায় বসে বেশী৷
একমাত্র ছেলে সোহাগ অনেক আরাধ্য এই ধন তাদের৷ ছেলেটা কিন্তু বেশ তুখার ছাত্র৷ শহরের নামকরা স্কুল থেকে এবারই উচ্চ মাধ্যমিকে বেশ ভাল ফল করে পাশ করেছে বলে পিতা মাতা সহ এলাকাবাসীও একটা একটা স্বপ্ন দেখেছে এই ছেলেকে নিয়ে৷ আবার জয়েন্টের প্রস্তুতিও ছিল তার বেশ ভালই৷
সামন্ত বাবুরও বড়ই ইচ্ছা একমাত্র ছেলেকে ডাক্তারী পড়াবেন ঠিক সেই মত জয়েন্টে বসেছিল সে কৃতকার্যও হয়েছিল৷
যেদিন জয়েন্টে সোহাগ কৃতকার্য হলো পৃথিবীর সারা সুখ আর আনন্দধরা যেন এই চা পরিবারে ছড়িয়ে পড়ল৷ মায়া অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়েছিল তা দিয়ে তরিঘরি পাড়ার দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে গেল৷ ও বাবা সেখানে তো আর
খেলা? প্রচণ্ড ভির দোকানে যেন মানুষ পহেলা বৈশাখের জন্য মিষ্টি কিনছে৷ এমন ভির তো এদোকানে দেখা যায় না৷ একজন মহিলা ক্রেতা একটা মিষ্টি জোর করে মায়ার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল বাড়ি যাও আমরা আসছি৷ আমরা সবই শুনেছি আর এই কারনেই ও (তার স্বামী)
আমাকে মিষ্টি কিনতে পাঠাল৷ মায়াও সানন্দে তাকে মিষ্টি মুখ করালেন৷
বাড়িতে যেন আজ মহোৎসব মিষ্টিমুখের পাড়া প্রতিবেশি সবায় মিলে৷
মহা আনন্দে ঘিরে উঠা মহুর্ত আস্তে আস্তে শেষ হয়ে এল আর মায়ার সংসারে একটা দুঃশ্চিন্তার পাহাড় চাপা দিতে শুরু করল৷ এই ছেলেকে তারা ডাক্তারী পড়াবেন কি করে? প্রচুর খরচ যে এই শিক্ষাক্ষেত্রে, যা এই সামান্য চাওয়ালার দ্বারা কি করে সম্ভব হবে এই ভেবে৷
পরদিন সকালে দোকানে বেশ ভির লোকজনের সবাই তাকে আর ছেলেকে অভিনন্দন জানাতে আসছে৷ এমন সময় সাংবাদিক এসেও হাজির৷ পুঙ্খানুপঙ্খু সাক্ষাৎকার নিল বাবা আর ছেলের৷
বাবা তাঁর দুঃশ্চিন্তার কথা বললেন যে, কি করে এই চা বিক্রি করে ছেলেকে পড়াবেন?
পরদিন কাগজে বেড়িয়ে পড়ল ছেলেটির পুরো ইতিহাস সঙ্গে সেই চা দোকানের ছবি৷ চারিদিক থেকে আসতে শুরু করেছে সাহায্যের হাত, সমাজসেবি, সেচ্চাসেবক সংগঠন এমন কি প্রশাসন পর্যন্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, প্রতিবেশীরা তো আছেনই৷
ভর্তি হয়ে গেল কলকাতার এস এস কে এম মেডিক্যাল কলেজে৷ শুরু হলো ডাক্তার হবার স্বপ্ন৷ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষের মাঝপথ পর্যন্ত কোন ক্রমে পার করতে পরলেন সামন্ত বাবু ঐ চায়ের দোকান থেকেই বড় কষ্টে কিন্তু আর যেন পেরে উঠছেন না৷ ভোর চারটা থেকে রাত সারে এগার বারটা পর্যন্ত দোকান চালিয়েও জীবন যুদ্ধে যেন পিছিয়ে পরার পরিস্থিতি উপনীত হতে হচ্ছে তাকে ৷ কি আর করা যায় বাজারে তো সুদে টাকা পাওয়া যায়৷ এবার ঐ পথেই হেঁটে ছেলের পড়ার খরচ আর অন্যান্য খরচ যোগার করতে থাকেন৷ আর তাঁকে টাকা সুদে দিতেও সুদখোরেরা দ্বিধা করেনা৷ কারণ ছেলে তো প্রায় ডাক্তার হয়েই গেছে তখন তো সুদ আসলে উসুল করতে সমস্যা থাকবে না৷
একদিন হঠাৎ ছেলেটা বাড়ীতে চলে এল সকালে৷ মা মায়া যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল ছেলেকে দেখে, কখনও গালে, কখনও মুখে, কখন কপালে পাগলের মত চুমু খেতে শুরু করল৷ এ আদর যেন সোহাগ ঠিক সহ্য করতে পারছিল না৷ এক সময় বলেই বসল "তোমার ওসব ন্যাকামো আমার পছন্দ না ছাড় তো৷ মায়া ঠিক কথাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ঘারের ব্যাগটা খুলে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলল আরাম কর বাবা কত রাস্তা ট্রেনে এসেছিস আমি তোর খাবার করছি৷ কতদিন আমার হাতের খাবার খাসনি৷
সমান্তবাবু তো ভোরবলা দোকানে চলে গেছেন, বাড়িতে ছেলে এসেছে তাও তার জানা নেই৷ দোকানে আজ তেমন বিক্রিও নেই, তাই বউয়ের সঙ্গে নেহায়েত সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেই একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বাড়ী চলে এলেন বাড়ীতে৷
কই গো বৌ ঝটপট এক কাপ চা বানাও দেখি গলাটা ভিজিয়েই যাই,বলে
চেয়ারে বসে কাগজে মনোযোগ দিলেন৷ সামন্ত খুব আদর করে স্ত্রীকে ওই "বৌ" বলেই ডাকে সোহাগ জন্মের পর থেকেই৷
খোকা এসেছে জান?
তাই না কি? তা কি করে জানব তুমি কি জানিয়েছ আগে? এইমাত্র কানে দিলে তো তা খোকা খুব রোগা হয়ে গেছে নাগো?
না না একদম ঠিক আছে৷ তারাতারী বাজারটা করে আনতে হবে কিন্তু বলে মায়া বাজারের ব্যাগটা হাতে দিয়ে বলল বড় মাছ আর সঙ্গে একটু ছোট মাছও নিতে কিন্তু৷ হাজার হোক ছেলে এসেছে আর ছেলের ছোট মাছের চচ্চরী খুব পছন্দ৷
সামন্ত বাবু ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে অন্তত গলা ভিজনোর ব্যবস্থাটা তো কর ? বাজার দেখছি৷
তোমাকে না বলেছি দোকান থেকে গলা ভিজিয়ে আসবে?
আরে বৌ গলা তো ভিজিয়েই এসেছি
কিন্তু তোমার হাতের চায়ের মজাই আলাদা৷ আর আমার হাত তো চা বানতে বানাতে পচে গেছে৷ দাও তারাতারী করো বলে উঠে গিয়ে ছেলেকে ঘরে দেখে আসে সামন্ত যে ছেলে ঘুমোচ্ছে৷
মায়া চা বানিয়ে দেয় চায়ে চুমুক দিয়ে
সামন্ত খবরের কাগজে আবার মন দিয়ে পড়তে পড়তে বলে ও বৌ দেখে যাও একটা খবর৷ মায়া পাশে এলে বলে বোম্বের এক ফ্লাটে ছেলে আর বউ বুড়ো বাবা মাকে ঝি চাকরের চেয়ে অমানবিক ব্যবহার করছে যা কোনদিনই করা উচিৎ নয়৷
আচ্ছা বৌ আমাদের তো আবার অমন
কিছূ ভাগ্যে নেই তো?এমনই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মায়াকে৷
মায়া সহাস্যে বলে তোমারও মাথা খারাপ আমাদের ছেলে সোনা নয়, বল হীরের টুকরো কোনদিনই অমন হবে না৷ কি
যে উল্টাপাল্টা ভাব তুমি৷ যাও যাও বাজারে যাও আমার অনেক কাজ, বলে মায়া বেড়িয়ে যায়৷
সামন্ত না হওয়ায় তো সবায় চায় বৌ কিন্তু তবুও যে হয়ে যায়, এটাই যে আসল সত্য বলে বেড়িয়ে আসে সামনে৷
মায়া একটু আদরের সুরে গাল দু'টো টুক করে ধরে আবার বলে "আমাদের ছেলে অমন হতে পারে না, তুমি এখন বাজারে যাও"৷
তোমার চাঁদবদনে ফুল চন্দন পড়ুক বৌ, ফুল চন্দন পড়ুক৷ বলে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে যায়৷
মায়াও বেশ হাসিখুশী মনে একটা গানের কলি আওরাতে আওরাতে নিজ কাজে মন দেয়৷
প্রতিবেশী সহ অনেক মানুষই এই গরীব পরিবারকে ভালবাসেন, কারণ সামন্তবাবু ও তাঁর স্ত্রী ভীষণ ভাল, মিশুকে মানুষ আর মন সেতো স্বচ্ছ বেলজিয়াম কাঁচের মত৷
ওমন প্রাণখোলা মানুষ, তার মধ্যে আবার ছেলে ওমন একটা ভাল জায়গায় পৌঁছাতে সকলের আরও বেশী প্রিয় হয়েছে এই দম্পতি৷
সামন্ত দোকানে এসে বসল, মাথাটা একটু ঘুরতে শুরু করল তার, কারণ বৌ যে বাজারের লম্বা ফর্দ দিয়েছে তার একটি সামগ্রী কিনবার মত পয়সাও তো নেই, এই ভেবে তবুও আর কি ধার করে হলেও সবই আনতে হবে৷ একমাত্র ছেলে
এসেছে বলে কথা৷ ঠিক যেমন ভাবনা তেমনী কাজ করবে ভেবে বসে আছে দোকানে৷
এবার এলেন দোকানে তাঁরই এক হিতৈশী মনিশ মুখার্জী৷ বড় জ্ঞানীগুণী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক৷ ওনিও এক সময় সর্বদিকে সাহায্য করেছিলেন এই পরিবারকে৷
দাদা সোহাগ এসেছে আজ কলকাতা থেকে চরম আনন্দে কথাটা মুখার্জী বাবুকে বললেন অর ওনিও বেশ আনন্দে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললেন
এবার তো ফাইনাল এয়ার না সামন্ত?
না দাদা, ফোর্থ এয়ার ৷
তবে তোমার সু-দিনের আর বেশী দেরি নেই৷ সামনে বছর পাশ করলেই ইন্টার্নশিপ চালু হবে আর তখন থেকেই স্টাইপেনও পাবে, তোমাকেও কিছু কিছু সাহায্য করতে পারবে৷
এমন ব্যাপার তা তো জানতাম না দাদা?
সোহাগ কোনদিন বলেনি তোমাকে যে MBBS পাশের পর ইন্টার্নশীপ করতে সরকার থেকে স্টাইপেন দেওয়া হয়?
কই না তো? আমি ওসব কিছু জানিও না আর বলেও না, তবে ওর মাকে বলতে পারে৷ মা তো আবার ওকে খুব ভালবাসে৷
আর তুমি বুঝি ঘৃণা কর তোমার ছেলেকে? শোন, আর কেউ জানুক আর না জানুক আমি তো জানি তোমার ব্যাপারে৷ আজ কত টাকা তুমি সুদে নিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়েছ ঐ ছেলের জন্য? এমনি নানা কথা বলতে বলতে সোহাগ এসে হাজির দোকানে৷ আর এই ফাঁকে চা বানিয়ে দেয় মুখার্জী বাবুকে৷
সোহাগ সরসরী বাবাকে বলে বসে আমাকে ৩০০টা টাকা দাও৷ হতভম্ভ হয়ে সামন্ত বলে অত টাকা তো সকাল থেকে বিক্রিই হয়নি?
সোহাগ বলে তার জন্য কি আমি দায়ী? টাকাটা আমার এখনই দরকার৷
মুখার্জী বাবু হতবাক হয়ে শুধু মুখ তাকতাকি করে ৷ কখনও সোহাগ আবার কখনও সামন্তের দিকে আর ভাবে একি রূপ দেখছি আজ? অাগে তো নজরে আসেনি এমন কীর্তি সোহাগের৷ তবে কি এই ক'বছরে ওর এত পরিবর্তন? এমনি নানা ভাবনা ভাবতে থাকেন মহুর্তের মধ্যে৷
চিন্তায় মগ্ন মনে একটা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন৷
সামন্ত বলল তুই একটু বস আমি বাজারটা করে আনি, ছেলেকে বলতেই সে আবার বলে বসল টাকাটা কিন্তু নিয়ে আসবে৷
আমার টাকাটা কিন্তু নিয়ে আসবে
দেখছি—
দেখছি নয়, চাই ই আমার ৩০০টাকা
এবার সামন্ত বেড়িয়ে গেল বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে৷
আর মুখার্জী বাবু কিছু না বলে খবরের কাগজে মনোযোগ দিলেন৷ একটু পর একজন খদ্দের এসে চা বিস্কুট চাইতেই দোকানদার নেই বলে বিদাই করে দিল সেই লোকটাকে সোহাগ৷
এবার আর মুখার্জী বাবু চুপচাপ না থেকে বলেই ফেললেন "তুমি অন্তত বিস্কুট হাতে দিয়ে কিছুটা সময় ধরে রাখতে পারতে লোকটাকে আর এই সময়ে তোমার বাবাও এসে যেত৷
আমি কি চা বিক্রি করতে ডাক্তারী পড়ছি?
একটা বিস্কুট বোয়েম থেকে বের করে দিলে তোমার মান মর্যাদা একেবারে ধুলোয় মিশে যেত না?
সোহাগ একটু রাগান্বিত, একটু অভিমানে চুপ করে বসে রইল৷ একটু পর সামন্তু বাজারের ব্যাগ হাতে দোকানে এলো৷ আমার টাকাটা দাও আমি যাব৷
সামন্ত একটু অস্বস্তি হলে তা কেটে উঠে বলল বাজারটা বাড়ি দিয়ে আসতে৷
আমার দ্বারা সম্ভব নয় বলে দাঁড়িয়ে গেল৷
এবার আবার মুখ খুললেন মুখার্জী বাবু৷ আচ্ছা, বাজারটা বাড়ীতে দিয়ে এলে কি তুমি ডাক্তার থেকে ডিমোশন হয়ে মোক্তার হয়ে যাবে নাকি?
এবার সোহাগ লজ্জায়, রাগে মুখ তাকাতাকি
করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে গট গট করে হাটতে শুরু করল আর বলে গেল ওর ৩০০ টাকা রেডি রাখতে৷
মুখার্জী বাবু এবার বলেই বসলেন "সামন্ত তুমি যা ভেবে ছেলের পিছনে সর্বস্ব শেষ করেছ তোমার এ ত্যাগের মূল্য পাবে বলে আমার মনে হয়৷ তোমার ছেলে অনেক বদলে গেছে, যে ছেলে একদিন আমাকে দেখলে কেমন আছেন জেঠু? জ্যেঠীমা কেমন আছেন, আপনার বিপি ঠিক আছেতো? এমনই অনেক প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করত অথচ আজ প্রায় একঘন্টা পর্যন্ত মনে হলো ও আমাকে কোনদিন দেখেছে বলে মনেই হয় না৷
খুবই দুঃখ পেলাম৷ এমনি ভাবেই মনের অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন৷ এই মানুষটির কাছেই সোহাগ স্কুল জীবনে ফিজিক্সের অনেক জটিল সুত্র আর অনেক অজানা জেনেছে আর আজ যেন তাঁকে চিনেও চিনতে পারছে না৷ এখনই এমন অবস্থা তবে বড় ডাক্তার হলে তো ও কাউকেই চিনবে না এমনই নানা চিন্তা ভাবনা করছিলেন মনে মনে৷
এমন সময় সোহাগ বাড়ী থেকে এসে আবার সেই তিনশো টাকার তাগাদা৷ এবার আর কি করা আবার সেই হাত পাতা ব্রজেন বাবুর কাছে৷ টাকা এনে দিল আর মুখার্জী বাবু শুধু দেখছেন আর ভাবছেন তাকে নিয়ে৷ ওনি তো মানুষ গড়ার কারিগর ওনি সবই বুঝতে পারলেন, যে এই ছেলে কতদুর পর্যন্ত নীচে নামতে পারে৷
এদিকে দাতাগণও মাঝে মাঝে এসে সুদের তাগাদা করে৷ সুদের টাকা দিতে না পারলে তা আবার আসলে যোগ হয়ে আসল ক্রমাগত বাড়তে থাকছে৷ এসব ভাবনা যে শুধু সামন্ত একাই ভাবে তা নয় মুখার্জী বাবু বেশ ভাবেন এসব নিয়ে৷ এছেলে যে জীবনে
বাবা মাকে দুঃখ দিয়েই যাবে তা তাঁর বুঝতে মোটেই দেরী হলো না৷
দেড় বছর পর
এবার সোহাগ বাড়ি এল শীতের সময় কোট স্যুট টাই পরিহিত৷ সেই সোহাগ মা যেন তাকে চিনতে বেশ কষ্ট পাচ্ছে, তবুও মায়া খুশীতে আটখানা ডাক্তার ছেলেকে
দেখে৷ কিন্তু এতদিন পর বাড়ীতে এলো নিজেস্ব আয়ের একটা সুতার দর্শনও কি পিতামাতার জন্য আনতে হয় না? তখন তো সে রিতীমত ভালই ভাতা পাচ্ছে৷ তবুও বাবা মার প্রতি একটুও কৃতজ্ঞতা
নেই তার, এ এক চরম দুঃখজনক ঘটনা
রাতে বাবা মা ছেলে সবাই খাবার পর
একসঙ্গে আলোচনায় বসল৷ বাবা ছেলেকে বলল বাবা আমি প্রায় লাখ দেড়েক টাকা ঋণ করে ফেলেছি তোর জন্য সুদে আসলে ও দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে এখন তো তোর কিছু আয় হচ্ছে অন্তত প্রতিমাসে কিছু টাকা আমার কাছে পাঠিয়ে দে ওদের একটু শান্ত করি৷
ঋণের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সোহাগ, বলে বসে ঋণ করেছ তুমি আর শোধ করব আমি?
তোর জন্যই তো আমার এই ঋণের বোঝা মাথায় নেওয়া একথা বলার পর আরও রেগে বলে আমার জন্য মানে আমার জন্য তুমি করেছই বা কি যা করেছে আমার হবু শ্বশুর করেছে৷ তোমরা তো ভর্তি করে দিয়েই খালাস?
আকাশ ভেঙ্গে পরল যেন সামন্ত আর মায়ার মাথায় একি বলছে তাদের একমাত্র সন্তান? যার জন্য দিনরাত স্বামী স্ত্রী অবিরাম পরিশ্রম করে টাকা পাঠিয়েছে সে কি না বলে আমরা কিছুই করিনি ওর জন্য? যা করেছে ওর হবু শ্বশুর করেছে? দুঃখ, বেদনা, ক্লেশ, আঘাতে যেন এই দম্পতি নুইয়ে গেল, এমন তো হবার কথা নয়, অথচ এমনই কিছু হয়ে গেল, যা ভাবনার বাহিরে এক দুঃস্বপ্নের মত হয়ে দুজনেই মাথা নুইয়ে নীরব বোবা কান্নায় ডুকরে ডুকরে ফুঁফরে ফুঁফরে উঠতে শুরু করল৷
এমন সময় সোহাগের মোবাইল বেজে উঠল সঙ্গে সঙ্গে সে বাহিরে বেড়িয়ে গেল৷
বেশ কিছুক্ষণ বাহিরে কথা বলার পর ঘরে এসে বলল৷ আমি এখনই কলকাতা
বেড়িয়ে যাচ্ছি আর হয়তো কোনদিন অার তোমাদের বিরক্ত করতে আসব না৷
নির্বাক হয়ে শুধু সামন্ত ছেলের মুখে একবার তাকিয়ে দেখল আর মায়া বারবার বলতে শুরু করল কেন আসবি না? কি অন্যায় করেছি আমরা? জীবন মেরে তোকে মানুষ করা যদি অামাদের অপরাধ হয় তবে আর আসিস না, নিজে
না খেয়ে যদি তোকে টাকা পাঠিয়ে তোর খাবার ব্যবস্থা করা অপরাধ হয়, তবে তোকে আর আসতে বলব না৷ বাধ্য হয়ে তোর জন্য ঋণ করা যদি আমাদের অন্যায় হয় তবে আর আসতে হবে না৷ এই বাড়ী বিক্রি করে তোর জন্য করা ঋণ আমরা শোধ করে ঐ বটতলাই গিয়ে থাকব, তোকে আর আসতে হবে না৷ রাগে দুঃখে জ্বলেপুরে অঙ্গার হয়ে এমন করে
বলেই চলেছে মায়া আর নির্বাক সামন্ত দু'গালে হাত দিয়ে অঝরে অশ্রুধারা ঝড়াচ্ছে৷
সোহাগ গটগট করে হেটে ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে চলে গেল কোন কথা না বলে৷
পিছু পিছু মায়া খোকা খোকা বলে ডাকতে ডাকতে ছুটল -----
এবার সামন্ত মায়া মায়া বলতে বলতে পিছনে পিছনে ছুটল৷ কোন লাভ নেই মায়া কোন লাভ নেই ওকে যেতে দাও৷ ও আর তোমার সন্তান নেই ও এখন ওর হবু শ্বশুরের অনুগত হয়ে গেছে ও আর আমাদের হবে না, ওর আমাদের প্রয়োজন শেষ হয়েছে, আমাদের প্রয়োজন শেষ হয়েছে, শেষ হয়েছে বলে দুজনে কান্নায় ভেঙ্গে পরে৷
আর সোহাগ ফোনে কথা বলতে বলেতে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রিক্সায় চেপে বসে৷
আর কখনও বাবা মার দিকে ফিরে দেখেনি সোহাগ৷ বিয়েও করেছে৷ হয়তো এখন বেশ উপার্জন করছে কিন্তু সামন্ত সেই চা ই ঘাটছে আজও৷ আজ তার বসত বাড়ীটাও বিক্রি করে ছেলের জন্য করা ঋণ শোধ করতে হয়েছে৷ আজ সে সরকারী রেলের জায়গায় কোন রকমে মাথা গুঁজে দিনাতীপাত করছে৷
এ গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল সোহাগের শ্বাশুরী আর সঙ্গ
দিয়েছিল তার হবু স্ত্রী৷ বাস্তব বড় কঠিন বড়ই আসার, বড়ই বেদনা দায়ক৷
Kalipada Roy
গৃহযুদ্ধ
কালীপদ রায়
শহরের রেল স্টেশন সংলগ্ল এমনই একটি চায়ের দোকান চালান সামন্ত বাবু৷ ইচ্ছা থাকা সত্বেও শিক্ষায় খুব একটা এগোতে পারেননি তিনি অর্থনৈতিক চরম কষাঘাতের কারণে৷
মোটামোটি দোকানটা চলে, তবে খুব যে চলে তেমন নয়, আড্ডায় বসে বেশী৷
একমাত্র ছেলে সোহাগ অনেক আরাধ্য এই ধন তাদের৷ ছেলেটা কিন্তু বেশ তুখার ছাত্র৷ শহরের নামকরা স্কুল থেকে এবারই উচ্চ মাধ্যমিকে বেশ ভাল ফল করে পাশ করেছে বলে পিতা মাতা সহ এলাকাবাসীও একটা একটা স্বপ্ন দেখেছে এই ছেলেকে নিয়ে৷ আবার জয়েন্টের প্রস্তুতিও ছিল তার বেশ ভালই৷
সামন্ত বাবুরও বড়ই ইচ্ছা একমাত্র ছেলেকে ডাক্তারী পড়াবেন ঠিক সেই মত জয়েন্টে বসেছিল সে কৃতকার্যও হয়েছিল৷
যেদিন জয়েন্টে সোহাগ কৃতকার্য হলো পৃথিবীর সারা সুখ আর আনন্দধরা যেন এই চা পরিবারে ছড়িয়ে পড়ল৷ মায়া অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়েছিল তা দিয়ে তরিঘরি পাড়ার দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে গেল৷ ও বাবা সেখানে তো আর
খেলা? প্রচণ্ড ভির দোকানে যেন মানুষ পহেলা বৈশাখের জন্য মিষ্টি কিনছে৷ এমন ভির তো এদোকানে দেখা যায় না৷ একজন মহিলা ক্রেতা একটা মিষ্টি জোর করে মায়ার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল বাড়ি যাও আমরা আসছি৷ আমরা সবই শুনেছি আর এই কারনেই ও (তার স্বামী)
আমাকে মিষ্টি কিনতে পাঠাল৷ মায়াও সানন্দে তাকে মিষ্টি মুখ করালেন৷
বাড়িতে যেন আজ মহোৎসব মিষ্টিমুখের পাড়া প্রতিবেশি সবায় মিলে৷
মহা আনন্দে ঘিরে উঠা মহুর্ত আস্তে আস্তে শেষ হয়ে এল আর মায়ার সংসারে একটা দুঃশ্চিন্তার পাহাড় চাপা দিতে শুরু করল৷ এই ছেলেকে তারা ডাক্তারী পড়াবেন কি করে? প্রচুর খরচ যে এই শিক্ষাক্ষেত্রে, যা এই সামান্য চাওয়ালার দ্বারা কি করে সম্ভব হবে এই ভেবে৷
পরদিন সকালে দোকানে বেশ ভির লোকজনের সবাই তাকে আর ছেলেকে অভিনন্দন জানাতে আসছে৷ এমন সময় সাংবাদিক এসেও হাজির৷ পুঙ্খানুপঙ্খু সাক্ষাৎকার নিল বাবা আর ছেলের৷
বাবা তাঁর দুঃশ্চিন্তার কথা বললেন যে, কি করে এই চা বিক্রি করে ছেলেকে পড়াবেন?
পরদিন কাগজে বেড়িয়ে পড়ল ছেলেটির পুরো ইতিহাস সঙ্গে সেই চা দোকানের ছবি৷ চারিদিক থেকে আসতে শুরু করেছে সাহায্যের হাত, সমাজসেবি, সেচ্চাসেবক সংগঠন এমন কি প্রশাসন পর্যন্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, প্রতিবেশীরা তো আছেনই৷
ভর্তি হয়ে গেল কলকাতার এস এস কে এম মেডিক্যাল কলেজে৷ শুরু হলো ডাক্তার হবার স্বপ্ন৷ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষের মাঝপথ পর্যন্ত কোন ক্রমে পার করতে পরলেন সামন্ত বাবু ঐ চায়ের দোকান থেকেই বড় কষ্টে কিন্তু আর যেন পেরে উঠছেন না৷ ভোর চারটা থেকে রাত সারে এগার বারটা পর্যন্ত দোকান চালিয়েও জীবন যুদ্ধে যেন পিছিয়ে পরার পরিস্থিতি উপনীত হতে হচ্ছে তাকে ৷ কি আর করা যায় বাজারে তো সুদে টাকা পাওয়া যায়৷ এবার ঐ পথেই হেঁটে ছেলের পড়ার খরচ আর অন্যান্য খরচ যোগার করতে থাকেন৷ আর তাঁকে টাকা সুদে দিতেও সুদখোরেরা দ্বিধা করেনা৷ কারণ ছেলে তো প্রায় ডাক্তার হয়েই গেছে তখন তো সুদ আসলে উসুল করতে সমস্যা থাকবে না৷
একদিন হঠাৎ ছেলেটা বাড়ীতে চলে এল সকালে৷ মা মায়া যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল ছেলেকে দেখে, কখনও গালে, কখনও মুখে, কখন কপালে পাগলের মত চুমু খেতে শুরু করল৷ এ আদর যেন সোহাগ ঠিক সহ্য করতে পারছিল না৷ এক সময় বলেই বসল "তোমার ওসব ন্যাকামো আমার পছন্দ না ছাড় তো৷ মায়া ঠিক কথাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ঘারের ব্যাগটা খুলে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলল আরাম কর বাবা কত রাস্তা ট্রেনে এসেছিস আমি তোর খাবার করছি৷ কতদিন আমার হাতের খাবার খাসনি৷
সমান্তবাবু তো ভোরবলা দোকানে চলে গেছেন, বাড়িতে ছেলে এসেছে তাও তার জানা নেই৷ দোকানে আজ তেমন বিক্রিও নেই, তাই বউয়ের সঙ্গে নেহায়েত সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেই একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বাড়ী চলে এলেন বাড়ীতে৷
কই গো বৌ ঝটপট এক কাপ চা বানাও দেখি গলাটা ভিজিয়েই যাই,বলে
চেয়ারে বসে কাগজে মনোযোগ দিলেন৷ সামন্ত খুব আদর করে স্ত্রীকে ওই "বৌ" বলেই ডাকে সোহাগ জন্মের পর থেকেই৷
খোকা এসেছে জান?
তাই না কি? তা কি করে জানব তুমি কি জানিয়েছ আগে? এইমাত্র কানে দিলে তো তা খোকা খুব রোগা হয়ে গেছে নাগো?
না না একদম ঠিক আছে৷ তারাতারী বাজারটা করে আনতে হবে কিন্তু বলে মায়া বাজারের ব্যাগটা হাতে দিয়ে বলল বড় মাছ আর সঙ্গে একটু ছোট মাছও নিতে কিন্তু৷ হাজার হোক ছেলে এসেছে আর ছেলের ছোট মাছের চচ্চরী খুব পছন্দ৷
সামন্ত বাবু ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে অন্তত গলা ভিজনোর ব্যবস্থাটা তো কর ? বাজার দেখছি৷
তোমাকে না বলেছি দোকান থেকে গলা ভিজিয়ে আসবে?
আরে বৌ গলা তো ভিজিয়েই এসেছি
কিন্তু তোমার হাতের চায়ের মজাই আলাদা৷ আর আমার হাত তো চা বানতে বানাতে পচে গেছে৷ দাও তারাতারী করো বলে উঠে গিয়ে ছেলেকে ঘরে দেখে আসে সামন্ত যে ছেলে ঘুমোচ্ছে৷
মায়া চা বানিয়ে দেয় চায়ে চুমুক দিয়ে
সামন্ত খবরের কাগজে আবার মন দিয়ে পড়তে পড়তে বলে ও বৌ দেখে যাও একটা খবর৷ মায়া পাশে এলে বলে বোম্বের এক ফ্লাটে ছেলে আর বউ বুড়ো বাবা মাকে ঝি চাকরের চেয়ে অমানবিক ব্যবহার করছে যা কোনদিনই করা উচিৎ নয়৷
আচ্ছা বৌ আমাদের তো আবার অমন
কিছূ ভাগ্যে নেই তো?এমনই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মায়াকে৷
মায়া সহাস্যে বলে তোমারও মাথা খারাপ আমাদের ছেলে সোনা নয়, বল হীরের টুকরো কোনদিনই অমন হবে না৷ কি
যে উল্টাপাল্টা ভাব তুমি৷ যাও যাও বাজারে যাও আমার অনেক কাজ, বলে মায়া বেড়িয়ে যায়৷
সামন্ত না হওয়ায় তো সবায় চায় বৌ কিন্তু তবুও যে হয়ে যায়, এটাই যে আসল সত্য বলে বেড়িয়ে আসে সামনে৷
মায়া একটু আদরের সুরে গাল দু'টো টুক করে ধরে আবার বলে "আমাদের ছেলে অমন হতে পারে না, তুমি এখন বাজারে যাও"৷
তোমার চাঁদবদনে ফুল চন্দন পড়ুক বৌ, ফুল চন্দন পড়ুক৷ বলে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে যায়৷
মায়াও বেশ হাসিখুশী মনে একটা গানের কলি আওরাতে আওরাতে নিজ কাজে মন দেয়৷
প্রতিবেশী সহ অনেক মানুষই এই গরীব পরিবারকে ভালবাসেন, কারণ সামন্তবাবু ও তাঁর স্ত্রী ভীষণ ভাল, মিশুকে মানুষ আর মন সেতো স্বচ্ছ বেলজিয়াম কাঁচের মত৷
ওমন প্রাণখোলা মানুষ, তার মধ্যে আবার ছেলে ওমন একটা ভাল জায়গায় পৌঁছাতে সকলের আরও বেশী প্রিয় হয়েছে এই দম্পতি৷
সামন্ত দোকানে এসে বসল, মাথাটা একটু ঘুরতে শুরু করল তার, কারণ বৌ যে বাজারের লম্বা ফর্দ দিয়েছে তার একটি সামগ্রী কিনবার মত পয়সাও তো নেই, এই ভেবে তবুও আর কি ধার করে হলেও সবই আনতে হবে৷ একমাত্র ছেলে
এসেছে বলে কথা৷ ঠিক যেমন ভাবনা তেমনী কাজ করবে ভেবে বসে আছে দোকানে৷
এবার এলেন দোকানে তাঁরই এক হিতৈশী মনিশ মুখার্জী৷ বড় জ্ঞানীগুণী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক৷ ওনিও এক সময় সর্বদিকে সাহায্য করেছিলেন এই পরিবারকে৷
দাদা সোহাগ এসেছে আজ কলকাতা থেকে চরম আনন্দে কথাটা মুখার্জী বাবুকে বললেন অর ওনিও বেশ আনন্দে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললেন
এবার তো ফাইনাল এয়ার না সামন্ত?
না দাদা, ফোর্থ এয়ার ৷
তবে তোমার সু-দিনের আর বেশী দেরি নেই৷ সামনে বছর পাশ করলেই ইন্টার্নশিপ চালু হবে আর তখন থেকেই স্টাইপেনও পাবে, তোমাকেও কিছু কিছু সাহায্য করতে পারবে৷
এমন ব্যাপার তা তো জানতাম না দাদা?
সোহাগ কোনদিন বলেনি তোমাকে যে MBBS পাশের পর ইন্টার্নশীপ করতে সরকার থেকে স্টাইপেন দেওয়া হয়?
কই না তো? আমি ওসব কিছু জানিও না আর বলেও না, তবে ওর মাকে বলতে পারে৷ মা তো আবার ওকে খুব ভালবাসে৷
আর তুমি বুঝি ঘৃণা কর তোমার ছেলেকে? শোন, আর কেউ জানুক আর না জানুক আমি তো জানি তোমার ব্যাপারে৷ আজ কত টাকা তুমি সুদে নিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়েছ ঐ ছেলের জন্য? এমনি নানা কথা বলতে বলতে সোহাগ এসে হাজির দোকানে৷ আর এই ফাঁকে চা বানিয়ে দেয় মুখার্জী বাবুকে৷
সোহাগ সরসরী বাবাকে বলে বসে আমাকে ৩০০টা টাকা দাও৷ হতভম্ভ হয়ে সামন্ত বলে অত টাকা তো সকাল থেকে বিক্রিই হয়নি?
সোহাগ বলে তার জন্য কি আমি দায়ী? টাকাটা আমার এখনই দরকার৷
মুখার্জী বাবু হতবাক হয়ে শুধু মুখ তাকতাকি করে ৷ কখনও সোহাগ আবার কখনও সামন্তের দিকে আর ভাবে একি রূপ দেখছি আজ? অাগে তো নজরে আসেনি এমন কীর্তি সোহাগের৷ তবে কি এই ক'বছরে ওর এত পরিবর্তন? এমনি নানা ভাবনা ভাবতে থাকেন মহুর্তের মধ্যে৷
চিন্তায় মগ্ন মনে একটা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন৷
সামন্ত বলল তুই একটু বস আমি বাজারটা করে আনি, ছেলেকে বলতেই সে আবার বলে বসল টাকাটা কিন্তু নিয়ে আসবে৷
আমার টাকাটা কিন্তু নিয়ে আসবে
দেখছি—
দেখছি নয়, চাই ই আমার ৩০০টাকা
এবার সামন্ত বেড়িয়ে গেল বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে৷
আর মুখার্জী বাবু কিছু না বলে খবরের কাগজে মনোযোগ দিলেন৷ একটু পর একজন খদ্দের এসে চা বিস্কুট চাইতেই দোকানদার নেই বলে বিদাই করে দিল সেই লোকটাকে সোহাগ৷
এবার আর মুখার্জী বাবু চুপচাপ না থেকে বলেই ফেললেন "তুমি অন্তত বিস্কুট হাতে দিয়ে কিছুটা সময় ধরে রাখতে পারতে লোকটাকে আর এই সময়ে তোমার বাবাও এসে যেত৷
আমি কি চা বিক্রি করতে ডাক্তারী পড়ছি?
একটা বিস্কুট বোয়েম থেকে বের করে দিলে তোমার মান মর্যাদা একেবারে ধুলোয় মিশে যেত না?
সোহাগ একটু রাগান্বিত, একটু অভিমানে চুপ করে বসে রইল৷ একটু পর সামন্তু বাজারের ব্যাগ হাতে দোকানে এলো৷ আমার টাকাটা দাও আমি যাব৷
সামন্ত একটু অস্বস্তি হলে তা কেটে উঠে বলল বাজারটা বাড়ি দিয়ে আসতে৷
আমার দ্বারা সম্ভব নয় বলে দাঁড়িয়ে গেল৷
এবার আবার মুখ খুললেন মুখার্জী বাবু৷ আচ্ছা, বাজারটা বাড়ীতে দিয়ে এলে কি তুমি ডাক্তার থেকে ডিমোশন হয়ে মোক্তার হয়ে যাবে নাকি?
এবার সোহাগ লজ্জায়, রাগে মুখ তাকাতাকি
করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে গট গট করে হাটতে শুরু করল আর বলে গেল ওর ৩০০ টাকা রেডি রাখতে৷
মুখার্জী বাবু এবার বলেই বসলেন "সামন্ত তুমি যা ভেবে ছেলের পিছনে সর্বস্ব শেষ করেছ তোমার এ ত্যাগের মূল্য পাবে বলে আমার মনে হয়৷ তোমার ছেলে অনেক বদলে গেছে, যে ছেলে একদিন আমাকে দেখলে কেমন আছেন জেঠু? জ্যেঠীমা কেমন আছেন, আপনার বিপি ঠিক আছেতো? এমনই অনেক প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করত অথচ আজ প্রায় একঘন্টা পর্যন্ত মনে হলো ও আমাকে কোনদিন দেখেছে বলে মনেই হয় না৷
খুবই দুঃখ পেলাম৷ এমনি ভাবেই মনের অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন৷ এই মানুষটির কাছেই সোহাগ স্কুল জীবনে ফিজিক্সের অনেক জটিল সুত্র আর অনেক অজানা জেনেছে আর আজ যেন তাঁকে চিনেও চিনতে পারছে না৷ এখনই এমন অবস্থা তবে বড় ডাক্তার হলে তো ও কাউকেই চিনবে না এমনই নানা চিন্তা ভাবনা করছিলেন মনে মনে৷
এমন সময় সোহাগ বাড়ী থেকে এসে আবার সেই তিনশো টাকার তাগাদা৷ এবার আর কি করা আবার সেই হাত পাতা ব্রজেন বাবুর কাছে৷ টাকা এনে দিল আর মুখার্জী বাবু শুধু দেখছেন আর ভাবছেন তাকে নিয়ে৷ ওনি তো মানুষ গড়ার কারিগর ওনি সবই বুঝতে পারলেন, যে এই ছেলে কতদুর পর্যন্ত নীচে নামতে পারে৷
এদিকে দাতাগণও মাঝে মাঝে এসে সুদের তাগাদা করে৷ সুদের টাকা দিতে না পারলে তা আবার আসলে যোগ হয়ে আসল ক্রমাগত বাড়তে থাকছে৷ এসব ভাবনা যে শুধু সামন্ত একাই ভাবে তা নয় মুখার্জী বাবু বেশ ভাবেন এসব নিয়ে৷ এছেলে যে জীবনে
বাবা মাকে দুঃখ দিয়েই যাবে তা তাঁর বুঝতে মোটেই দেরী হলো না৷
দেড় বছর পর
এবার সোহাগ বাড়ি এল শীতের সময় কোট স্যুট টাই পরিহিত৷ সেই সোহাগ মা যেন তাকে চিনতে বেশ কষ্ট পাচ্ছে, তবুও মায়া খুশীতে আটখানা ডাক্তার ছেলেকে
দেখে৷ কিন্তু এতদিন পর বাড়ীতে এলো নিজেস্ব আয়ের একটা সুতার দর্শনও কি পিতামাতার জন্য আনতে হয় না? তখন তো সে রিতীমত ভালই ভাতা পাচ্ছে৷ তবুও বাবা মার প্রতি একটুও কৃতজ্ঞতা
নেই তার, এ এক চরম দুঃখজনক ঘটনা
রাতে বাবা মা ছেলে সবাই খাবার পর
একসঙ্গে আলোচনায় বসল৷ বাবা ছেলেকে বলল বাবা আমি প্রায় লাখ দেড়েক টাকা ঋণ করে ফেলেছি তোর জন্য সুদে আসলে ও দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে এখন তো তোর কিছু আয় হচ্ছে অন্তত প্রতিমাসে কিছু টাকা আমার কাছে পাঠিয়ে দে ওদের একটু শান্ত করি৷
ঋণের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সোহাগ, বলে বসে ঋণ করেছ তুমি আর শোধ করব আমি?
তোর জন্যই তো আমার এই ঋণের বোঝা মাথায় নেওয়া একথা বলার পর আরও রেগে বলে আমার জন্য মানে আমার জন্য তুমি করেছই বা কি যা করেছে আমার হবু শ্বশুর করেছে৷ তোমরা তো ভর্তি করে দিয়েই খালাস?
আকাশ ভেঙ্গে পরল যেন সামন্ত আর মায়ার মাথায় একি বলছে তাদের একমাত্র সন্তান? যার জন্য দিনরাত স্বামী স্ত্রী অবিরাম পরিশ্রম করে টাকা পাঠিয়েছে সে কি না বলে আমরা কিছুই করিনি ওর জন্য? যা করেছে ওর হবু শ্বশুর করেছে? দুঃখ, বেদনা, ক্লেশ, আঘাতে যেন এই দম্পতি নুইয়ে গেল, এমন তো হবার কথা নয়, অথচ এমনই কিছু হয়ে গেল, যা ভাবনার বাহিরে এক দুঃস্বপ্নের মত হয়ে দুজনেই মাথা নুইয়ে নীরব বোবা কান্নায় ডুকরে ডুকরে ফুঁফরে ফুঁফরে উঠতে শুরু করল৷
এমন সময় সোহাগের মোবাইল বেজে উঠল সঙ্গে সঙ্গে সে বাহিরে বেড়িয়ে গেল৷
বেশ কিছুক্ষণ বাহিরে কথা বলার পর ঘরে এসে বলল৷ আমি এখনই কলকাতা
বেড়িয়ে যাচ্ছি আর হয়তো কোনদিন অার তোমাদের বিরক্ত করতে আসব না৷
নির্বাক হয়ে শুধু সামন্ত ছেলের মুখে একবার তাকিয়ে দেখল আর মায়া বারবার বলতে শুরু করল কেন আসবি না? কি অন্যায় করেছি আমরা? জীবন মেরে তোকে মানুষ করা যদি অামাদের অপরাধ হয় তবে আর আসিস না, নিজে
না খেয়ে যদি তোকে টাকা পাঠিয়ে তোর খাবার ব্যবস্থা করা অপরাধ হয়, তবে তোকে আর আসতে বলব না৷ বাধ্য হয়ে তোর জন্য ঋণ করা যদি আমাদের অন্যায় হয় তবে আর আসতে হবে না৷ এই বাড়ী বিক্রি করে তোর জন্য করা ঋণ আমরা শোধ করে ঐ বটতলাই গিয়ে থাকব, তোকে আর আসতে হবে না৷ রাগে দুঃখে জ্বলেপুরে অঙ্গার হয়ে এমন করে
বলেই চলেছে মায়া আর নির্বাক সামন্ত দু'গালে হাত দিয়ে অঝরে অশ্রুধারা ঝড়াচ্ছে৷
সোহাগ গটগট করে হেটে ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে চলে গেল কোন কথা না বলে৷
পিছু পিছু মায়া খোকা খোকা বলে ডাকতে ডাকতে ছুটল -----
এবার সামন্ত মায়া মায়া বলতে বলতে পিছনে পিছনে ছুটল৷ কোন লাভ নেই মায়া কোন লাভ নেই ওকে যেতে দাও৷ ও আর তোমার সন্তান নেই ও এখন ওর হবু শ্বশুরের অনুগত হয়ে গেছে ও আর আমাদের হবে না, ওর আমাদের প্রয়োজন শেষ হয়েছে, আমাদের প্রয়োজন শেষ হয়েছে, শেষ হয়েছে বলে দুজনে কান্নায় ভেঙ্গে পরে৷
আর সোহাগ ফোনে কথা বলতে বলেতে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রিক্সায় চেপে বসে৷
আর কখনও বাবা মার দিকে ফিরে দেখেনি সোহাগ৷ বিয়েও করেছে৷ হয়তো এখন বেশ উপার্জন করছে কিন্তু সামন্ত সেই চা ই ঘাটছে আজও৷ আজ তার বসত বাড়ীটাও বিক্রি করে ছেলের জন্য করা ঋণ শোধ করতে হয়েছে৷ আজ সে সরকারী রেলের জায়গায় কোন রকমে মাথা গুঁজে দিনাতীপাত করছে৷
এ গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল সোহাগের শ্বাশুরী আর সঙ্গ
দিয়েছিল তার হবু স্ত্রী৷ বাস্তব বড় কঠিন বড়ই আসার, বড়ই বেদনা দায়ক৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন